হিন্দু কে ? হিন্দু বলে কি আসলেই কিছু আছে?
ভারত হল সম্প্রদায়ের স্তূপ। এখানে রয়েছে পারসি, খ্রিষ্টান, মুসলমান এবং হিন্দু। এই সম্প্রদায়গুলোর ভিত জাতিগত নয়, অবশ্যই ধর্মীয় – এটা একটা ভাসা ভাসা ধারণা। একজন পারসি কেন পারসি, একজন খ্রিষ্টান কেন খ্রিষ্টান, একজন মুসলিম কেন মুসলিম, একজন হিন্দু কেন হিন্দু – এটা জানা আগ্রহোদ্দীপক।
পারসি, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের ক্ষেত্রে এর উত্তর বেশ সহজ। একজন পারসিকে যদি তার পারসি হবার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়, তবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তার সমস্যা হবে না। সে বলবে সে যেহেতু জরথ্রুস্টের অনুসারী, তাই সে পারসি। একই প্রশ্ন একজন খ্রিষ্টানকে জিজ্ঞেস করা হলে, তারও এর উত্তর দিতে সমস্যা হবে না। সে উত্তর দেবে, যেহেতু সে যিশু খ্রিষ্টে বিশ্বাস করে তাই সে একজন খ্রিষ্টান। একই প্রশ্ন যদি কোনো মুসলমানের সামনে রাখা হয়, সে এর উত্তর দিতে কোনো দ্বিধা করবে না। সে বলবে, সে ইসলামে বিশ্বাস করে, তাই সে একজন মুসলিম। এখন একই প্রশ্ন একজন হিন্দুকে জিজ্ঞেস করুন। নিঃসন্দেহে সে হতভম্ব হয়ে পরবে এবং এর কি উত্তর দিতে হবে তা জানবে না।
যদি সে বলে, সে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতাকে উপাসনা করে বলে সে হিন্দু, তবে তার উত্তর সঠিক নয়। সকল হিন্দু একই দেবতার উপাসনা করে না। কিছু হিন্দুরা একেশ্বরবাদী, কিছু বহুদেবতাবাদী এবং কিছু সর্বেশ্বরবাদী। এমনকি একেশ্বরবাদী হিন্দুরাও একই ঈশ্বরের উপাসনা করে না। অনেকে বিষ্ণুর আরাধনা করে, অনেকে শিবের, অনেকে রামের, অনেকে কৃষ্ণের। অনেকে পুরুষ দেবতাদের আরাধনা করে না। তারা এক দেবীর আরাধনা করে। এমনকি তারা সকলে একই দেবীর আরাধনা করে না। কেউ কালির আরাধনা করে, কেউ পার্বতীর, কেউ লক্ষ্মীর।
বহুদেবতাবাদীরা সব দেবতার আরাধনা করে। তারা বিষ্ণু, শিব, রাম, কৃষ্ণের উপাসনা করে। কালি, পার্বতী, লক্ষ্মীরও উপাসনা করে। একজন হিন্দু শিবরাত্রির দিনে উপবাস করে কারণ এটা শিবের পবিত্র দিন। সে একাদশীতে উপবাস করে কারণ এটা বিষ্ণুর পবিত্র দিন। শিবের কাছে পবিত্র বলে সে বেল গাছ লাগায়। বিষ্ণুর কাছে পবিত্র বলে সে তুলশী গাছ লাগায়।
বহুদেবতাবাদী হিন্দুরা তাদের শ্রদ্ধা হিন্দু দেবতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে না। কোনো হিন্দু কোনো মুসলমান পির বা খ্রিষ্টান দেবীকে পূজা করতে ইতস্তত বোধ করে না। হাজার হাজার হিন্দুরা মুসলমান পিরের উপাসনা করতে যায়।কিছু জায়গায় ব্রাহ্মণেরা মুসলমান পীরের পোশাক পরিধান করে এবং পীরের উত্তরাধিকার লাভ করেছে। হাজার হাজার হিন্দুরা বম্বের কাছে খ্রিষ্টান দেবী মান্ত মৌলির উপাসনা করতে যায়। খ্রিষ্টান বা মুসলমান দেবতার উপাসনা মাঝে মাঝে হয়ে থাকে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আরো স্থায়ী ধর্মীয় শ্রদ্ধার আদান প্রদান রয়েছে। অনেক তথাকথিত হিন্দু রয়েছে যাদের ধর্মে অনেক স্থায়ী মুসলমান উপাদান রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অদ্ভূত পাচপিরিয়া মতের অনুসারীরা। তারা অজ্ঞাত পরিচয় পাঁচ জন মুসলমান পিরের উপাসনা করে, তাদের উদ্দেশ্যে মুরগি বলি দেয় এবং এই কাজের জন্য মুসলিম দাফালি ফকিরের পৌরোহিত্যের সেবা গ্রহণ করে। সারা ভারতজুড়ে অনেক হিন্দু মুসলমান পীরদের মাঝারে তীর্থ করতে যায়। যেমনঃ পাঞ্জাবের সাখি সরোবর।
মালকানাদের সম্বন্ধে মি. ব্লান্ট বলেন, মালকানারা হল আগ্রা এবং তার সন্নিহিত জেলার বিশেষত মুত্তারা, ইত্তাহ এবং মাইনপুরির বিভিন্ন জাতের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া মুসলমান। তারা রাজপুত, জাঠ ও বেণিয়া বংশের। তারা নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিতে চায় না। তারা সাধারণত তাদের আসল জাতের পরিচয় দেয় এবং কখনো কখনো তারা নিজেদের মালকানা বলেও পরিচয় দেয়। তারা হিন্দু নাম ব্যবহার করে, হিন্দু মন্দিরে পূজা করে এবং রাম-রাম বলে অভিবাদন করে। তারা একমাত্র নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করে। আবার কখনো তারা মসজিদে নামাজ পড়তে আসে, নিজেদের লিঙ্গ কর্তন করে এবং মৃতদের কবর দেয়। তারা মুসলমান বন্ধুদের সাথে খাওয়াদাওয়া করে।
গুজরাটে মাতিয়া কুনবিসের মত কিছু সম্প্রদায় রয়েছে যারা পির ইমাম শাহ এবং তার শিষ্যদের অনুসারী হয়েও, তাদের বিশেষ অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণকে দিয়ে করায়। তারা মুসলমানদের মত তাদের মৃতদের কবর দেয়। শেইখ দাসরা তাদের বিয়েতে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় পুরোহিত নিয়োগ করে। মোমেনেরা লিঙ্গ কর্তন করে, মৃতদের কবর দেয় এবং গুজরাটি কুরান পড়ে ; আবার অন্যদিকে হিন্দু রীতি এবং অনুষ্ঠান পালন করে।
যদি কোনো হিন্দু বলে, “আমি হিন্দু, কারণ আমি হিন্দুর বিশ্বাস ধারণ করি”, তবে তার উত্তর সঠিক নয়, কারণ হিন্দুদের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মমত নেই। খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে যতটা না বিশ্বাসের পার্থক্য আছে, হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি বিশ্বাসের পার্থক্য রয়েছে। হিন্দুদের মূল ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন। কেউ বলে সকল ধর্মগ্রন্থ গ্রহণযোগ্য, কেউ তন্ত্রকে এর থেকে বাদ দেয়, কেউ শুধুমাত্র বেদকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, কেউ মনে করে হিন্দু ধর্মের মূল বিষয়বস্তু হল কর্ম ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস। হিন্দু ধর্ম হল জটিল ধর্মবিশ্বাস ও মতবাদের স্তূপ। এতে একেশ্বরবাদ, বহুদেবতাবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের স্থান রয়েছে৷ এর মধ্যে শিব, বিষ্ণু বা তার স্ত্রীদের উপাসকদের স্থান রয়েছে এবং বৃক্ষ, পাথর, নদী, গ্রাম দেবতার পূজকদের স্থান রয়েছে। যারা তাদের দেবতাদের সকল প্রকারের রক্তাক্ত বলির মাধ্যমে সন্তুষ্ট করে এবং যারা শুধুমাত্র কোনো প্রাণীকে হত্যা করেনা তাই নয় বরং ‘বধ’ শব্দটাই ব্যবহার করে না, হিন্দু ধর্মে এদের স্থান রয়েছে। যারা মূলত প্রার্থনা এবং স্তুতি করে, যারা ধর্মের নামে অকথ্য গুপ্ত সাধনায় লিপ্ত হয়, তাদের স্থান হিন্দু ধর্মে রয়েছে। হিন্দু ধর্ম অনেক প্রথাবিরোধী সম্প্রদায়ের আশ্রয়স্থল, যাদের অনেকে ব্রাহ্মণের আধিপত্য অস্বীকার করে, অথবা তাদের মধ্যে অন্তত অব্রাহ্মণ ধর্মগুরু রয়েছে।
যদি কোনো হিন্দু বলে হিন্দুর প্রথা পালন করার ফলে সে হিন্দু, একথাও সত্য হতে পারে না। কারণ সকল হিন্দুরা একই প্রথাসমূহ পালন করে না।
উত্তর ভারতে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হয় না কিন্তু দক্ষিণে চাচাতো-মামাতো বোন বিবাহের বিধান রয়েছে এবং এমনকি আরও নিকটয়াত্মীয়দের মধ্যে বিবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। নিয়মানুসারে নারীর সতীত্বের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে কিন্তু কিছু সম্প্রদায়ে বিবাহের পূর্বে এতে বেশ ছাড় দেওয়া হয়। কেউ নিজের মেয়েকে ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তিতে ঠেলে দেয়। কিছু স্থানে নারীরা স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করে, কোথাও তাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়। কোথাও কেউ ঘাগরা পরে, কোথাও সালোয়ার পরা হয়।
আবার যদি সে বলে, সে বর্ণপ্রথায় বিশ্বাস করে বলে সে হিন্দু, তবে তার উত্তর সন্তোষজনক বলে মেনে নেওয়া যায় না। এটা সত্য যে, কোনো হিন্দুই তার প্রতিবেশি কিসে বিশ্বাস করে তাতে আগ্রহী নয় কিন্তু সে তার সাথে খেতে পারবে কিনা, তার কাছ থেকে জল গ্রহণ করতে পারবে কিনা এতে সে অধিক আগ্রহী। অন্য কথায় বর্ণ প্রথা হিন্দু ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যার হিন্দু বর্ণাশ্রমে স্থান নেই তাকে হিন্দু বলা যাবে না। কিন্তু এসব সত্য হওয়ার পরেও এটা ভুলে গেলে চলে না যে শুধুমাত্র বর্ণের উপস্থিতি যথেষ্ট নয়। অনেক মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে বর্ণপ্রথা রয়েছে, খাওয়ার বাছবিচারের ক্ষেত্রে না হলেও পরস্পরের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু এর ফলেই তাদের হিন্দু বলা যায় না। তার হিন্দু হতে হবে এবং তার বর্ণপ্রথা পালন করতে হবে। এই দুটোরই উপস্থিতি থাকতে হবে। এটা আমাদের আবার পুরোনো প্রশ্নে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, হিন্দু কে? আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেলাম।
প্রত্যেক হিন্দুর কাছে কি প্রশ্নটি বিবেচনার যোগ্য নয় তার নিজের ধর্মের ক্ষেত্রে তার অবস্থান কেন এতটা লজ্জাজনক, এতটা হতবুদ্ধিকর? প্রত্যেক পারসি, খ্রিষ্টান, মুসলমান যার উত্তর দিতে সক্ষম, সে কেন তার উত্তর দিতে সক্ষম নয়? এটা কি সেই সময় নয় যখন তার নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিত, কি কারণে তার ধর্মে এই বিশৃঙ্খলা?
( ভীমরাও আম্বেদকরের ‘Riddles in Hinduism’ গ্রন্থের ‘THE DIFFICULTY OF KNOWING WHY ONE IS A HINDU’ থেকে অনুবাদিত। )