ভূমিকা: বর্তমানে সনাতন ধর্মকে ধ্বংশ করার জন্যে কয়েকটি দল প্রায় সনাতন শাস্ত্র নিয়ে অপপ্রচার করে আসতেছে। তারা নতুন করে পিতামহ ব্রহ্মাকে নিয়ে অপপ্রচার শুরু করেছে। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্টিকার তৈরি করে অপপ্রচারের চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অপপ্রচারের ভাইরাসরা পিতামহ ব্রহ্মাকে এডিটিং এর মাধ্যমে অস্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার চালিয়ে সাধারণ সনাতনীদের বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। আর সাধারণ সনাতনীদের কাছে কোনো উওর না থাকায় তারাও বিভ্রান্তের স্বীকার হচ্ছে।যেমন পিতামহ ব্রহ্মা, নারায়ণের আদেশে সৃষ্টি রচনা শুরু করলেন। তখন পিতামহ ব্রহ্মা, তার পশ্চাদ্দেশ থেকে কামাগ্র অসুর সৃষ্টি করেছেন। তখন সে অসুর পিতামহ ব্রহ্মার সাথে মৈথুন করতে চেয়েছেন। পরে ব্রহ্মা সেখান থেকে ভয়ে পালিয়ে চলে এসেছেন। মূলত খণ্ড শ্লোক নিয়েই তারা অপপ্রচার করে থাকেন। পাঠকবৃন্দগণ ধৈর্য সহকারে সম্পূর্ণ তথ্যটি অনুধাবন করুন। এবং পাঠকগণ অপপ্রচারের দল গুলো ব্রহ্মার এই কাহিনী উপস্থাপন করে পিতামহ ব্রহ্মাকে নিয়ে একটি অস্বাভাবিক স্টিকার তৈরি করেছে। স্টিকারটি আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে আপনাদের সামনে প্রকাশিত করলাম। দেখুন অপসংস্কৃতির ভাইরসরা কতটুকু নিম্ন শ্রেণীর ব্যক্তি।
এই স্টিকারটি লক্ষ্য করুন । এখানে পিতামহ ব্রহ্মাকে অস্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করেছে। সাথে পরমেশ্বর শিবকে সহ বিকৃত করেছে। যে অপপ্রচার ভাইরাসটি এই স্টিকারটি তৈরি করেছে। তাকে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। এখানে আপনারাই বললেন অসুররা ব্রহ্মার প্রতি ধাবমান হয়েছেন। তাহলে এখানে ব্রহ্মার কি দোষ? অসুররা তো ধাবমান হয়েছিলো কিন্তু ধর্ষন তো করেন নি। ব্রহ্মা সেখান থেকে চলে এসেছেন। তাহলে এই স্টিকারটি কিসের ভিত্তিতে তৈরি করলেন। আর এই স্টিকারটি দুই শ্রেনীর ভাইরাসরা প্রচার করে থাকে। একটি দয়ানন্দের শিষ্য আর্য সমাজ। আরেকটি হলো অসনাতনী। তারা খণ্ড শ্লোক উপস্থাপন করে পিতামহ ব্রহ্মাকে বিকৃতি করে সাধারণ সনাতনীদের বিভ্রান্ত করিয়ে তাদের দল ভারি করার জন্যে অপপ্রচারের করে।
আমাদের জবাব
প্রথমেই আমাদের জানা প্রয়োজন । ব্রহ্মা কোনো একটি ব্যক্তি বিশেষ নন। এবং ব্রহ্মা ঈশ্বরতত্বও নন। সনাতন শাস্ত্রে ব্রহ্মা শব্দটি পদবী হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। ব্রহ্মা আমাদের মতোই জীব তত্ত্বাবধায়ক। ব্রহ্মাই প্রতিটি কল্পে সৃষ্টির প্রথম জীব হিসেবে বিষ্ণুর নাভী পদ্ম থেকে আবির্ভূত হোন। শাস্ত্রীয় কাল গননা অনুযায়ী ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল ১০০ বছর। তারপর ব্রহ্মা অন্তর্ধান ঘটে। এইভাবেই ৬ জন ব্রহ্মা অতিক্রম করেছেন। বর্তমানে আমরা সপ্তম ব্রহ্মার অধীনে নির্বাচিত হয়েছি। তাহার নাম শতানন্দ। তাহার পর আরো ব্রহ্মা আসবেন।
স্কন্ধ পুরাণ থেকে শব্দচয়নে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,বর্তমান সপ্তম ব্রহ্মার নাম শতানন্দ। তাহার পর অষ্টম ব্রহ্মার নাম হবেন চতুর্ষ্মখ। এটা থেকে বুঝা যায় যে, ব্রহ্মা একটি পদবী, যেমন প্রধানমন্ত্রী একটি পদবী । এই পদবীতে অনেক ব্যক্তি বসেন আবার চলেও যান। ঠিক তদ্রুপ ব্রহ্মা একটি পদবী এই পদবীতে কিছু ব্যক্তি শাস্ত্রীয় কাল গণনা অনুযায়ী ১০০ বছর রাজত্ব করেন। তারপর তারা অন্তর্ধান গ্রহণ করেন। এখান থেকে ধারণা হলো যে ব্রহ্মা ঈশ্বর নন। তিনি জীব তত্ত্বাবধায়ক।
এবার বিস্তারিত….
তস্য নাভেরভূৎ পদ্মং সহস্রাকোরুদীধিতি। সর্বজীবনিকায়ৌকো যত্র স্বয়মভূৎ স্বরাষ্ট্র ১৬॥ অর্থাৎ:- সেই গর্ভোদকশায়ী শ্রীভগবানের নাভিদেশ থেকে সহস্র সূর্যের দীপ্তিযুক্ত অতীব প্রভাময় একটি পদ্ম প্রকট হল। এই পদ্মই সমগ্ৰ জীবজগতের আবাসস্থান। স্বয়ং ব্রহ্মা পর্যন্ত ওই পদ্মের থেকে আবির্ভূত হন৷৷ ১৬ ৷
পর্যবেক্ষণ:- গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভী থেকে হাজার সূর্যের ন্যায় তেজ ধারণ করে একটি পদ্ম প্রকটিত হলো। আর এই পদ্ম থেকে স্বয়ং ব্রহ্মা আবির্ভূত হলেন।
সোহনুবিষ্টো ভগবতা যঃ শেতে সলিলাশয়ে। লোকসংস্থাং যথাপূর্বং নির্মমে সংস্থয়া স্বয়া৷৷ ১৭ অর্থাৎ:- ব্রহ্মাণ্ডের গর্ভরূপ জলে শায়িত শ্রীনারায়ণ যখন ব্রহ্মার অন্তঃকরণে প্রবিষ্ট হলেন, তখন ব্রহ্মা নামরূপাদিক্রমে পূর্বকল্পানুসারে লোক সৃষ্টি করতে প্রবৃত্ত হলেন৷৷ ১৭ ৷৷
পর্যবেক্ষণ:-( ১ )সেই ব্রহ্মা ভগবান্ কর্তৃক অনুবিষ্ট অর্থাৎ অধিষ্ঠিত হইয়া । তারপর সেই ব্রহ্মা বিষ্ণু কর্তৃক প্রেরিত হইয়া, সৃষ্টি কার্য শুরু করতে লাগলেন। ( ২ )নাম রূপাদি — যক্ষ,রাক্ষস,দৈত্য, মানুষ ইত্যাদি নাম (শ্রেনী) অনুসারেই রুপ এবং গুন দিতে শুরু করলেন। ( ৩ )পূর্বকল্পনা অনুসারে লোক সৃষ্টি করতে প্রবৃত্তি হলেন–আমরা সর্বপ্রথম স্কন্ধ পুরাণ থেকে দেখিয়েছি যে, ব্রহ্মা একটি পদবী। আর এই পদবীতে প্রতিটি কল্পে একজন করে ব্রহ্মা আসেন। আর এই ব্রহ্মাই ঈশ্বররের দ্বারা প্রেরিত হইয়া সৃষ্টি কার্য শুরু করেন। সর্বপ্রথম যে ব্রহ্মা ছিলেন তাহার নাম বিরিঞ্চি ।দ্বিতীয় ব্রহ্মার নাম পদ্মভূ । তৃতীয় ব্রহ্মার নাম স্বয়ম্ভু । এমন করে সাত জন ব্রহ্মা গত হয়েছেন। এই সাতজন ব্রহ্মার মতো সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই এই শ্লোকে বলেছেন পূর্ব্ব পূর্ব্ব কল্পে যেরূপ ছিল, সেইরূপ লোকসকল রচনা করিতে লাগিলেন । আমরা ভাগবতের এই ৩য় স্কন্ধের ২০ নাম্বার অধ্যায়ে তেমন(প্রতি কল্পের ন্যায় সৃষ্টি) সৃষ্টিতত্বই দেখতে পাই।
সসর্জচ্ছায়য়াবিদ্যা পঞ্চপর্বাণমগ্রতঃ। তামিস্রমন্ধতামিস্রং তমো মোহো মহাতমঃ৷৷ ১৮। অর্থাৎ:- সর্বপ্রথম তিনি নিজের ছায়া থেকে তামিস্র, অন্ধতামিস্র, তম, মোহ এবং মহামোহ (অজ্ঞান, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ) এই পঞ্চবিধ বৃত্তিসম্পন্ন অবিদ্যার সৃষ্টি করলেন৷ ১৮ ॥
পর্যবেক্ষণ :- দেখুন দেখুন পাঠকবৃন্দগণ এখানে শব্দচয়নে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ব্রহ্মা স্বয়ং নিজ স্বশরীরে না,অন্য একটি ব্রহ্মার ছায়া রূপে । ব্রহ্মা কর্তৃক স্রষ্টব্য যক্ষ, রাক্ষস, দেব, মনুষ্য প্রভৃতির দেহে জীবসমূহের অহঙ্কার অবিদ্যা ব্যতীত সম্ভব নয়, অতএব অবি- দ্যার বৃত্তিসমূহ নিজেই ব্রহ্মদ্বারা তমঃ প্রভৃতি রূপে প্রকাশ পাইলে ব্রহ্মা তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। ছায়া- রূপা তনুর দ্বারা অর্থাৎ তমের দ্বারা মোহ, মহামোহ, তামিস্র ও অন্ধতামিস্র – ইহারা যথাক্রমে অজ্ঞান, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ বলিয়া জানিতে হইবে
দেবোহদেবাঞ্জঘনতঃ সৃজতি স্মাতিলোলুপান্৷ ত এনং লোলুপতয়া মৈথুনয়াবিপেদিভে। ২৩। অর্থাৎ:- তারপর ব্রহ্মা নিজ জঘনদেশ থেকে কামাসক্ত অসুরদের সৃষ্টি করলেন। তারা অতিশয় কামলোলুপ হওয়ার ফলে সৃষ্ট হওয়া মাত্রই মৈথুনের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার দিকেই ধাবিত হল৷৷ ২৩
পর্যবেক্ষণ:- অনেকে হয়তো বলবে ব্রহ্মা তো পুরুষ বাচক শব্দ তাহলে ব্রহ্মার জঘনদেশ হতে কি করে সৃষ্টি হতে পারে? চলুন আমরা বাংলাদেশের জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশিত জয় নব অভিধান নির্বাচন করে। এখানে দেখা যাচ্ছে ,অভিধানেও দেখতে পেলাম জঘন শব্দের অর্থ স্ত্রীলোকের কটিদেশ ও ওই কটিদেশের সম্মুখভাগ অর্থাৎ যোনী। আমরা পূর্বের শ্লোকে শব্দচয়নে দেখেছি যে, ব্রহ্মা স্বয়ং নিজ স্বশরীরে না, অন্য একটি ব্রহ্মার ছায়া রূপে পঞ্চবিদ বৃত্তিসম্পূর্ন অবিদ্যার সৃষ্টি করলেন। এই শ্লোকটিতে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মার জঘন থেকে অসুররা সৃষ্টি হয়েছেন। অর্থাৎ ব্রহ্মার আরেক ছায়া রূপি নারীর জগন থেকে অসুরদের সৃষ্টি করেছেন। ব্রহ্মার স্বয়ং স্বশরীর দ্বারা নয়। ব্রহ্মার ছায়া রূপি নারীর জঘন থেকে অসুর সৃষ্টি করলেন। কামাসক্ত অসুররা কামলোলুপ হওয়ার ফলে ব্রহ্মার ছায়া রূপি নারীর দিকে ধাবমান হলেন। এখানে লক্ষনীয় বিষয় এই যে, ব্রহ্মা তো পুরুষ বাচক শব্দ, ব্রহ্মা যদি স্বয়ং স্বশরীরে অসুরদের সৃষ্টি করতেন। তাহলে অসুররা কি কামাসক্ত হয়ে পুরুষের কাছে ধাবমান হতেন? অপপ্রচারকারীরা এই শ্লোক তুলে ধরেই দাবি করে ব্রহ্মা নাকি স্বশরীরের পশ্চাৎপদ থেকে দৈত্যদের সৃষ্টি করেছেন। যদিও মূল শ্লোকে পশ্চাৎপদ নয় বরং জঘন দেশ লেখা আছে। জঘন শব্দের অর্থ পশ্চাৎপদ নয়। বরং নারীর যোনি কেই জঘন বলা হয়ে থাকে। পাঠকবৃন্দ খেয়াল করুন দৈত্যরা স্বাভাবতই নারীলোলুপ, অহংকারী হয়ে থাকে। তাঁরই নিমিত্তে তাঁরা ব্রহ্মার ছায়া রূপি নারীর দিকেই ধাবমান হয়েছেন। কারণ তাঁরা অতিশয় কামুক ছিলেন। এই জায়গায়তেই মূলতো তাঁরা অপপ্রচারের সুযোগ খুঁজে নিয়ে বলে ব্রহ্মার যেহেতু জঘন দেশ থাকবে না তখন তিনি পশ্চাৎ দ্বারাই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মোটেও তা নয়। কারণ ব্রহ্মা এখানে নারী রূপে ছিলেন। আর এই নারী রূপ দেখেই কামাসক্রত অসুররা ব্রহ্মার ছায়া রূপ নারীর দিকে ধাবমান হয়েছেন।
ততো হসন্ স ভগবানসুরৈর্নিরপত্রপৈঃ । অন্বীয়মানস্তরসা ক্রদ্ধো ভীতঃ পরাপতৎ৷৷ ২৪।অর্থাৎ:- এই কাণ্ড দেখে ব্রহ্মা প্রথমত হাসলেন ; কিন্তু পরে নির্লজ্জ অসুরদের দ্বারা এইভাবে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভীত হয়ে ক্রুদ্ধ ও শঙ্কিতচিত্তে দ্রুতবেগে পলায়ন করলেন। ২৪
পর্যবএক্ষণ:- (১)ব্রহ্মা প্রথমে হাসলেন— অসুররা যখন ব্রহ্মার ছায়া রূপের প্রতি কামাসক্ত হয়ে মৈথুন করতে চেয়েছিল। তখন তিনি কৌতুহল বশত হেসেছেন। কেননা ব্রহ্মার ছায়া রূপী যে নারীটি অসুরদের সৃষ্টি করেছেন সে নারীর প্রতিই অসুররা কামাসক্ত হয়ে মৈথুন করতে ধাবমান হয়েছেন। কারণ অসুররা অতিশয় কামুক ছিলেন। এবং তারা লম্পট ব্যক্তি ছিলেন। এই কারণেই পরের বচনে তাদের নির্লজ্জ অসুর বলেছেন। ( ২ )নির্লজ্জ অসুরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে — পাঠকবৃন্দগণ এখানে শব্দচয়নে দেখা যাচ্ছে অসুরদের নির্লজ্জ বলেছেন। এবং তারা ব্রহ্মার ছায়া রূপী নারীটিকে আক্রমণ করতে শুরু করলেন। পূর্বে দেখিয়েছি ব্রহ্মা ঈশ্বর নন। তাই স্বাভাবিকের ন্যায় তিনি ভয় পেয়েছেন। (৩)দ্রুত বেগে পলায়ন করলেন— ব্রহ্মা দ্রুত বেগে সে স্থান ত্যাগ করে শ্রীহরির শরনাপন্ন হলেন। এটাকেই অনুবাদকার পলায়ন করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। শ্রীহরি সবাই অন্তরেই বিরাজমান তাই তিনি ব্রহ্মার কাতরভাব দেখে বুঝতে পারলেন। ঠিক তখনই শ্রীহরি সমস্যার সমাধান করে দিলেন।
উপসংহার:- সনাতন শাস্ত্র অনেক গভীর তত্ত্বাবধায়ক। অনেকে না বুঝেই পিতামহ ব্রহ্মার নামে অপপ্রচার করছেন। দেখুন ব্রহ্মা কোনো ঈশ্বর নন। তিনি ভয় পেতেই পারেন। এতে সনাতন ধর্মের ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব খর্ব হয় না। কারণ ব্রহ্মা ঈশ্বরই নন। তিনি দেব মাত্র। আর জীবতত্বের অধীনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সবাই ভয় পাবেন এটাই স্বাভাবিক। এবং এখানে এটাও প্রমাণিত হয়েছে স্বয়ং ব্রহ্মাও ভয় পায় নি। ব্রহ্মার আরেক ছায়া রূপ ভয় পেয়েছেন। তাহলে আপনারা এমন স্টিকার কেন তৈরি করে সাধারণ সনাতনীদের বিভ্রান্ত করছেন?