সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, আমাদের ধর্মের নাম যে সনাতন ধর্ম এই কথাটি নাকি আমাদের কোন শাস্ত্রেই নাই এরকম দাবি করে আসছে কিছু আব্রাহামিক ধর্মমতের ব্যক্তিরা। তাঁদেরই অপযুক্তি খণ্ডনে এই লেখা। চলুন একাধিক শাস্ত্র থেকে শাস্ত্র প্রদর্শন সহ দেখে নিই। আমাদের “ধর্ম সনাতন” শাস্ত্রে সরাসরি উল্লেখ আছে কি নেই।
সূচনা
প্রথমে আমাদের সবার জানার প্রয়োজন সনাতন ধর্ম কী? সনাতন শব্দের অর্থ যা অতীতে ছিল, যা বর্তমান আছে, এবং যা ভবিষ্যতেও থাকবে। এবং ধর্ম শব্দের অর্থ হলো ধারণ করা। অর্থ্যাৎ [{আমরা (বহুবচন)} {আমি (একবচন)}] যা ধারণ করে আছি তাই সনাতনধর্ম। এবারে প্রশ্ন হতে পারে আমরা কি ধারণ করে আছি! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের স্বরূপ সম্পর্কে জানতে হবে। এখানেই সনাতনধর্মের বিশালতা ও আধ্যাত্মিকতা কেননা আমার স্বরূপ কি এই প্রশ্নের উত্তর শুধু হিন্দুদের শাস্ত্রেই আছে বাকি কোন মতাদর্শে নাই। এটা চ্যালেঞ্জ! এবারে জেনে নেন আমাদের স্বরূপ হলো “আমরা আত্মা”। আর এই আত্মার ধর্মই সনাতন। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে কি হিন্দু অহিন্দু সবাই সনাতন ধর্মের? উত্তর হলো শুধু হিন্দু অহিন্দুই নয় বরং সমস্ত জীবের ধর্মই সনাতন। ধর্ম এমন একটি বিষয় যা কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে? দেখুন উদাহরণ হিসাবে যদি বলা হয় – বলুন তো জলের ধর্ম কি? উত্তরে আসবে নিচের দিকে গড়িয়ে যাওয়া, এবং তিন অবস্থানে থাকে। আপনি আমি চাইলেও জলের এই ধর্মকে পরিবর্তন করতে পারবো না। আবার যদি উদাহরণ দিই যে আগুনের ধর্ম কি? উত্তরে আসবে তাপ, দাহ ইত্যাদি করা। আপনি আমি চাইলেও এই আগুনের ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবো না। তেমনি ভাবেই জীব মাত্রই সনাতন। সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান অথবা আব্রাহামিক মতামত বলতে কিছু নাই। আর এজন্যই বিশ্বে হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থেই প্রথম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন – জীবভূতঃ সনাতনঃ[ভগবদগীতা ১৫/৭]।
সনাতন ধর্মের প্রবর্তক কে:→ সনাতন ধর্মের ব্যাক্তি বাচক কোন প্রবর্তক নেই। এই ধর্ম শ্বাশত, অনাদি ধর্ম। এই ধর্মকে সরাসরি ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করা হয় কারণ ঈশ্বর যেমন অনাদি শ্বাশতকাল থেকে বর্তমান তেমনি সনাতনধর্ম অনাদিকাল থেকেই বর্তমান। এজন্য আমাদের ঈশ্বর যেমন সনাতন তেমনি আমাদের ধর্মের নাম সনাতন। নিচে প্রমাণ নেন [অথর্ববেদ -১০/৪/২২,২৩]
অথর্ববেদ সংহিতা [১০/৪/২৩] মন্ত্রটি অনুধাবন করুন। সনাতনমেনমানরুতাদ্য স্যাতপুর্ণবঃ। অহোরাত্রো প্রজায়েতে অন্যো অন্যস্য রূপয়ো।” অনুবাদঃ ঈশ্বরকে সনাতন বলা হয় কারন তিনি সদা নতুন; যেমন দিন ও রাত্রি একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিত্য নতুন রূপে জন্মগ্রহণ করেও সনাতন। এই বেদ মন্ত্রে ঈশ্বরকে সরাসরি ভাবে সনাতন বলা হয়েছে। এজন্যই এই সনাতনধর্মকে পরমেশ্বর ভগবানের আইন বলা হয়ে থাকে। প্রমাণ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ৬/৩/১৯ নং শ্লোক হতে– এই সত্য সনাতন ধর্ম প্রতক্ষ ভাবে ভগবদ প্রণীত। অর্থ্যাৎ একটি রাষ্ট্র যেমন সেই রাষ্টের সংবিধান মেনে চলে তেমনি ভাবে সনাতনধর্ম কোন ব্যক্তি বিশেষ দ্বারা পরিচালিত নয় এই ধর্ম সরাসরি ভাবে ঈশ্বর প্রণীত ধর্ম। আর এজন্যই আমরা গর্বিত কারণ একমাত্র সনাতনধর্মই ঈশ্বরের আইন তাছাড়া সব মতাদর্শই কোন না কোন ব্যক্তি দ্বারা প্রচারিত হয়েছে।
মূল আলোচনা
[এই অংশে বিভিন্ন শাস্ত্র প্রমাণ প্রদর্শনের মাধ্যমে দেখানো হবে আমাদের শাস্ত্রে আমাদের ধর্মের নামটি স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে। প্রথমে শ্রুতি প্রমাণ দেয়া হবে তারপর স্মৃতিপ্রমাণ এবং এভাবেই পর্যায়ক্রমে ইতিহাস ও পুরাণাদি থেকে প্রমাণ দেখানো হবে।]
শ্রুতি থেকে প্রমাণ
ঋগ্বেদে সনাতন ধর্ম-[৩/৩/১],মূল মন্ত্রটিতে “ধর্ম সনাতন” শব্দ চয়নে ফোঁটে উঠেছে। এবং ঋগবেদে মন্ত্র ভাগে স্পষ্ট অক্ষরে সনাতন ধর্মের কথাটি উল্লেখযোগ্য রয়েছে। নিচে প্রমাণ সহ শাস্ত্র দেখুন।
স্মৃতি শাস্ত্র সমূহ থেকে প্রমাণ
শ্রীমদ্ভাগবত গীতা
এবারে স্মৃতিশাস্ত্রের শিরোমণি শ্রীমদ্ভাগবদগীতা হতে প্রমাণ। শ্রীমদ্ভবদগীতা স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী জন্য এই জ্ঞানকে ব্রহ্মজ্ঞান বলা হয়ে থাকে।শ্রীমদ্ভগবদগীতা-[১১/১৮]
মনুসংহিতা
পরাশর সংহিতা
ইতিহাস শাস্ত্রসমূহ থেকে প্রমাণ
রামায়ণ
এবারে ইতিহাস শাস্ত্রাদি থেকে প্রমাণ। প্রথমেই রামায়ণ হতে [রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড ২৪/১৩]
আবারো রামায়ণ হতে প্রমাণ [রামায়ণ,অরণ্যকাণ্ড ৪/২২]
মহাভারত
এবার আমরা মহাভারত থেকেও প্রমাণ করবো আমাদের ধর্ম সনাতন। রামায়ণের মতোই মহাভারতেও পাতায় পাতায় ধর্ম সনাতন শব্দটি উল্লেখযোগ্য রয়েছে। আমারা মহাভারত থেকে একাধিক প্রমাণ যুক্ত করেছি। এক এক করে শাস্ত্র প্রদর্শন সহ দেখতে থাকুন।
[মহাভারত,বনপর্ব ৭৩/২৪-২৪] সনাতনধর্মের প্রবর্ত্তক অনাদিদেবতা সাক্ষাৎ মধুসূদন(কৃষ্ণ)। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংই সনাতন ধর্ম৷ আমরা পূর্বেই বলেছি সনাতনধর্ম ও ঈশ্বরে কোন প্রভেদ নাই। এছাড়াও মহাভারত অন্য পর্ব হতে প্রমাণ দেয়া করা হলো
[মহাভারত, শান্তিপর্ব ৫৫/১০] উপরোক্ত শ্লোকে সনাতন ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলা হয়েছে। অতত্রব হে অপপ্রচারকারীগণ সাবধান! কারণ সত্যের জয় সবসময়।
[মহাভারত শান্তিপর্ব ৫৬/১১] এই জগতে প্রজা রঞ্জন, সত্য রক্ষা ও সরল ব্যবহার করা রাজাদেরই সনাতন ধর্ম। অতত্রব সনাতন ধর্ম পালনকারী ব্যক্তিরা সহজ সরল৷
[মহাভারত, শান্তিপর্ব ৫৬/১৫] চারিবর্ণের ধর্মই সনাতন। এই এই সনাতনধর্মকে আমাদের সকল হিন্দুদেরই রক্ষা করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অতত্রব অপপ্রচারকারী আপনাদের দাবি মিথ্যা। সনাতন ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্ম নেই নিচে প্রমাণ দেওয়া হলো।
পুরাণসমগ্রঃ থেকে প্রমাণ
ভাগবত পুরাণ
এবারে পুরাণ হতে প্রমাণ।
শিব পুরাণ
নিচে আরো একটি পুরাণ থেকে প্রমাণ দেয়া হলো –
[সুধীজন বিচারক মণ্ডলী, উপরোক্ত প্রমাণ ছাড়াও আমাদের বহু শাস্ত্রেই আমাদের ধর্মের নাম স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে। তারপরেও যদি কেউ অস্বীকার করে তবে বুঝতে হবে অপপ্রচারকারীরা সত্যকে ভয় পায় তাই সত্য সামনে থাকলেও তাঁরা অস্বীকার করবেই। চলুন গর্ব করে বলি আমি সর্বশ্রেষ্ঠ, সত্য সনাতন ধর্মের অনুসারী। হে ভগবান আমাকে বারবার এই ধর্মেই জন্ম দিও। যেখানে সহজ, সরল, মুগ্ধতা দিয়ে ভরপুর। জয় সনাতন]
প্রশ্ন ও উত্তর
পূর্ব পক্ষের একটি দাবী→ সনাতন ধর্ম যদি হিন্দুদের ধর্মই হয় তবে সনাতন ধর্ম শব্দটি বিশেষ্য পদ হতে বিচ্যুতি হয়ে কেন বিশেষণ পদ হয়?
উত্তর পক্ষ → হে অশিক্ষিত অপপ্রচারকারী আমরা পূর্বেই বলেছি জীব মাত্রই সনাতন। তাই সনাতন বিশেষণ পদ রূপেই থাকবে। যেমন, জলের ধর্ম নিচের দিকে গড়িয়ে যাওয়া, শীতলতা দেওয়া। এবারে আপনাদের কাছে প্রশ্ন জলের শীতলতা ও নিচের দিকে গড়িয়ে যাওয়া কি বিশেষ্য পদ নাকি বিশেষণ পদ? আগুনের ধর্ম দাহ করা, দাহ করা কি বিশেষ্য পদ? যদি ভীতরে কালির অক্ষর অবশিষ্ট থাকে তবে আপনারা যে মতাদর্শের সেটাকে তো আপনারা ধর্ম বলি দাবি করেন তবে প্রমাণ করুণ সেটা সকল জীবের ধর্ম? খেয়াল রাখবেন ধর্ম কখনো সম্প্রদায় ভিত্তিক আলাদা আলাদা হয় না। কেননা আমরা স্বরুপতো এক আত্মা। আর আত্মা মাত্রই সনাতন। প্রমাণ 👇
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোয্য এব চ। নিত্যঃ সর্কগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ। [শ্রীমদ্ভগবদগীতা:- ২/২৪] অনুবাদঃ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোয্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।
SPS কর্তৃক প্রকাশিত একটি বাণী